bdupdates.org

বাংলাদেশের সংকলিত সব আপডেট

আয়নাঘর গল্প – ১০

কই দেখি কি হইছে তোর! এসব বলে, যেখানে ফুলে গেছে সেসব জায়গা জোরে জোরে চাপ দিতে দিতে বললো, এসব ব্যাপার না। তুই ভালোই আছস বলে গেটে তালা দিয়ে চলে গেল

সন্ধ্যার পর আমাদের সেলের সামনে যেই গার্ড থাকতো সেই কু লাঙ্গার একরাতে আমাকে এসে ডেকে বললো, উঠ যাওয়া লাগবে আমাদের সাথে। এটা বলেই জমটুপিটা পরিয়ে সেল থেকে বের করে উপরের দিকে নিয়ে যায়। তিনটা ফ্লোর হাটতে হয়েছে। ভিতরে নিয়েই চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলে।তারপর ওরা আমার চারপাশে বসে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে লাগলো। এবং সুন্দর করে বলতে লাগলো, তোরে কিন্তু ক্রস ফা য়ার দেওয়ার কথা, আমরা চাই না তোরে হারাইয়া তোর বোন আর মা অসহায় হইয়া পরুক। (ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইল করার চেষ্টা করছিল,যাতে আমি গলে গিয়ে তাদের ফাদে পা দেই) আমরা যা বলমু সেভাবে তুই কিছু স্বীকারোক্তি দিবি, তাইলে আমরা অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। তখন আমি বললাম, আমি কোন মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে পারবো না। সত্য হলে সেটা স্বীকার করতে হাজারবার প্রস্তুত।

তারপর তারা আমার বাবা মাকে নিয়ে যেসব কথা বললো, আমি শুনে শুনে শুধু কাঁদতেছিলাম। সেদিন যেই পরিমাণ চোখের পানি ঝরছিল। সারাজীবনে কেঁদেও মনে হয় না এতো পানি ঝরছে। গায়ের পাঞ্জাবিটা ভিজে শেষ। অনেক কাকুতি মিনতি করলাম। তারপর চারপাশ থেকে বেধরক কিলঘুষি মারা শুরু করলো, কু*** বাচ্চা বেশি সত্যবাদী হইছস? তোর সত্যবাদী দেখাইতেছি বলেই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হাত পায়ের হাড়গুলো গুড়া করে ফেলার মতো অবস্থা করেছিল। সেদিন হাত নাড়ানোর মতো শক্তিটাও ছিল না। রশি খুলে যখন সেলে নিয়ে যাবে তখন দাঁড়াচ্ছি না দেখে কান ধরে, দাড়ি টেনে বলছিল ভং না ধরে তাড়াতাড়ি দাঁড়া। আমাদের আরও কাজ আছে। তরে দিয়ে আসা লাগবে। কেন দাঁড়াচ্ছি না আবারও মারা শুরু করলো (আমি দাঁড়াতে পারছিলাম না)। এবার আমি চেয়ার থেকে পরে গেলাম। সেদিন কি হইছিল পরে আমি জানি না আর।

ঘুম ভাঙ্গার পর দেখি আমি সেলের মধ্যে। পুরা শরীরের যন্ত্রণায় কোঁকড়াচ্ছিলাম। গায়ে প্রচুর জ্বর। উঠে বসা তো দুরের কথা এপাশ ওপাশ করার শক্তিও নাই। অনেক কষ্টে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি নিচের ফাঁকা দিয়ে ৩-৪ লোকমা খাওয়ার মতো লাউ সবজি আর পঁচা ভাত দেওয়া। যার বাজে দুর্গন্ধ নাকে আসছিল। তখনই বমি করে দেই। শরীরে শক্তি না থাকায় খাবার পর্যন্ত হাত নিতে পারিনি। প্রচুর জ্বর আর ব্যাথার তীব্রতায় ঘুমিয়ে গেছিলাম। দুপুরের খাবার দেওয়ার জন্য যখন বাটিগুলো নিতে আসছিল তখনও আমি ঘুমাচ্ছিলাম। সেই খাবারটাই দুপুরে খাওয়ার জন্য বললো। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে ঘুম ভাঙ্গাইছে। কিন্তু বসার মতো শক্তি নাই। হাত পা ফুলে গেছে সব। আমি গার্ডকে চাচা, আঙ্কেল বলে অনেক রিকুয়েষ্ট করছিলাম যে, আমাকে একটু ভালো পানি আর ওষুধ কিনে দেন। আমি মরে যাচ্ছি। এটা বলা মাত্রই, জমিদারের বাচ্চা কয় কি! এখানে খাইতে আর ঘুমাইতে আইছস? গো লামের বাচ্চা আবার পানি ঔষধ চায়। আমি: আঙ্কেল আমি ব্যাথায় মরে যাচ্ছি প্লিজ আঙ্কেল! একটু ব্যবস্থা করে দেন না।

কোনোভাবেই তার মন গলানো গেল না। কই দেখি কি হইছে তোর! এসব বলে, যেখানে ফুলে গেছে সেসব জায়গা জোরে জোরে চাপ দিতে দিতে বললো, এসব ব্যাপার না। তুই ভালোই আছস বলে গেটে তালা দিয়ে চলে গেল। শীতকাল, ফ্লোরে পাতলা একটা ছেঁড়া ফাটা কম্বল, তার উপর কম্বলটা ভিজাইয়া দিয়ে গেছে। একদিকে পচা ভাতের গন্ধ আরেকপাশে বমি করা। ফ্লোরটা ভিজা। সে রাতে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলাম, আল্লাহ আমাকে আজকেই তোমার কাছে নিয়ে যাও, নয়তো ইবরাহীম আঃ- কে যেভাবে নমরুদের আগুন থেকে নিজের কুদরতিতে রক্ষা করেছিলে সেভাবে তোমার কুদরতি শক্তিতে আমার কষ্টটা লাঘব করে দাও। চিৎকার করে কাঁদছিলাম আর আল্লাহকে ডাকতেছিলাম।

___
তানভির মাহতাব

আয়নাঘর গল্প – ১০
Scroll to top