bdupdates.org

বাংলাদেশের সংকলিত সব আপডেট

পিলখানা হত্যাকান্ড তদন্ত

২০১৬ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ। আমি সেই সময়ে ইউএসএআইডি ফান্ডেড একটা প্রজেক্টে নিযুক্ত থাকার উপলক্ষে সুন্দরবনের গহীনে কাজ করি। দুই সপ্তাহ জঙ্গলের ভিতরে থাকি। গহিন অরন্য হবার কারণে মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে। আমার কাজ, এই প্রজেক্টের অধীনে, বন বিভাগের ফ্রন্টলাইন স্টাফদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা। দুই সপ্তাহ কঠোর পরিশ্রমের পর, পরের দুই সপ্তাহ খুলনা শহরে থাকি। অফিসে কাজ করি। আমার জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় চলে।

সেবার চৌদ্দতম দিনে মাত্রই সুন্দরবন থেকে বের হয়ে ডাঙ্গার দিকে আসছি। সাতক্ষীরা রেঞ্জের নীলডুমুর নামক স্থানে বোট ভিড়াবো। নেটওয়ার্কের ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই মোবাইলে রিং বেজে ওঠে। সাধারণত এতো দ্রুত কল আসে না। মোবাইল নেটওয়ার্কে ফেরত এলে মিসড কল এলার্ট মারফত আমি জানতে পারি, কে কতবার আমাকে কল দিয়ে পায় নাই। কিন্তু সরাসরি এতো দ্রুত কল প্রবেশ করা এই প্রথম। চেয়ে দেখি নম্বরটি সাব ইন্সপেক্টর রহমত ভাইয়ের। তিনি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ মিরপুরে কাজ করেন।

এসআই রহমত প্রবীণ কর্মকর্তা। তিনি পুলিশে প্রায় ৩০ বছর চাকুরী করে ফেলেছেন। তাঁকে আমার বিষয়ে এসাইন করা। যেহেতু হাসিনা সরকারের চোখে আমি অত্যন্ত উঁচু দরের অপরাধী, আমার পিছনে বিভিন্ন সংস্থার লোক লাগানো থাকে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী অধ্যায়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে যায়। সেনাবাহিনীর কাজের ধরণ পরিবর্তিত হয়। এমতাবস্থায় আমরা যারা কক্ষচ্যুত হই, তাঁদের জীবন বিষিয়ে তোলার জন্য হাসিনার বিভিন্ন এজেন্সি সদা তৎপর থাকতো। এসআই রহমত পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে অন গ্রাউন্ডে এসাইন ছিলেন। তাঁর আচরণ খুব ভালো। প্রথম দিনে তিনি আমাকে ফোন দিয়ে সাক্ষাৎ করেন। বলেন, “স্যার আমি কাহার আকন্দ স্যারের টিমে কাজ করেছি। পিলখানা হত্যাকাণ্ড তদন্তের সকল খুঁটিনাটি আমি জানি। আপনি আজ কেন এখানে, সব আমার জানা। আমাকে দিয়ে আপনার কোন ক্ষতি কখনোই হবে না।”

এসআই রহমত খুব অমায়িক আচরণ করেন। সুন্দরবন থেকে মাত্রই বের হয়ে, তাঁর ফোন দেখে ধরি।

এসআই রহমতঃ স্লামাইলিকুম। স্যার আপনি কোথায়? আপনার ফোন বন্ধ কেন?

আমি একটু অবাক হই। কারণ রহমত ভাই আমার রুটিন জানেন। আমি ২ সপ্তাহ আগে জঙ্গলে ঢুকার আগে তাঁকে ফোন দিয়ে জানিয়ে রেখেছি। তাহলে খুজার কি হল!

আমিঃ রহমত ভাই, আমি জঙ্গলের ভিতরে ছিলাম। মোবাইল নেট নাই। তাই খুঁজে পান নাই।

এসআই রহমতঃ স্যার, খবরে দেখেছেন কি ঘটনা ঘটেছে?

আমিঃ নাতো ভাই। নেটওয়ার্কে ঢুকেছি পাঁচ মিনিট হয় নাই। টেলিভিশন দেখবো কখন!

এসআই রহমতঃ আচ্ছা স্যার, অনেক বড় ঘটনা ঘটেছে। ঢাকাতে আর্টিজান নামের একটা রেস্টুরেন্টে ভয়াবহ স ন্ত্রা সী হা ম লা হয়েছে।

আমিঃ কি বলেন!

এসআই রহমতঃ জী স্যার। অনেক মানুষ খু ন হয়েছে। বিশাল ঘটনা।

আমিঃ ও আচ্ছা। ভয়ংকর ব্যাপার। একটু পরেই খোঁজ নিচ্ছি।

এসআই রহমতঃ তো স্যার আপনি তো জঙ্গলের ভিতরেই ছিলেন তাই না?

আমিঃ জী ভাই। এটা আপনি জানেন। তাও কেন জিজ্ঞেস করেন!

রহমত ভাই ফোন কেটে দেয়।

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে জানতে পারি, এই অতি বুদ্ধিমান প্রাণীরা আমাকে এই ঘটনার সাথে পেঁচানোর একটা নিয়ত করেছিল। পরে অনেক চেষ্টা করেও আগাতে পারে নাই। উপরের মহলের নির্দেশে গাধামি করতে গেলে যা হয় আর কি!

এর মাঝে অনেক ধরনের ঝামেলা হয়েছে। ইউএসএআইডি প্রজেক্টে এইচআর ডিপার্টমেন্টে এক পাকনা কাজ করতো। তাঁর ভাই আবার আর্মি অফিসার। সে আমাকে খুব ভয়াবহ ভাবে ম্যানেজমেন্টের কাছে উপস্থাপন করে। পুলিশের উৎপাত তো আছেই। সব কিছু মিলিয়ে এক পর্যায়ে খুলনা অধ্যায় প্রায় শেষের দিকে। ঢাকাতে একটা চাকুরির ইন্টার্ভিউ দিয়েছি। চাকুরী হয়েছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খুলনা শহরে আমার শেষ দুই সপ্তাহ কাটাচ্ছি। এমন এক সময়ে এসআই রহমতের ফোন।

“রাজীব স্যার, আপনাকে একটু জরুরী ভিত্তিতে ঢাকা আসতে হবে। আমাদের পু লি শের স্পেশাল ব্রাঞ্চের কয়েকজন স্যার আপনার সাথে কথা বলবেন।”

আমার নার্ভাস লাগে। আর কতো! নিয়মিত ডিস্টার্ব লেগেই আছে।

আমি কারণ জানতে চাই। তিনি জানান, কারণ তাঁর জানা নেই। আমি তখন একবার ভাবি, কোন অথরিটিতে তিনি আমাকে খুলনা থেকে ঢাকাতে ডেকে পাঠিয়েছেন! পরে আর জিজ্ঞাসা করি না। কি হবে জিজ্ঞাসা করে। এরা সবাই বলে, “উপরের মহলের নির্দেশ”। আর সেই মহল কে, আমি জানি।

অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঢাকা রওয়ানা হই। পথে মাওয়া ফেরি ঘাটে মারাত্মক জ্যাম। ঢাকা পৌঁছাতে ভোর হয়। বাসায় যেয়ে গোসল করে তৈরি হই। আমাকে দেখা করতে হবে বেলা দশটায়। স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) অফিসে। আমি ফর্মাল পোশাক পড়ে তৈরি হই। আমার মাথায় রাজ্যের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু বাসার কাউকে কারণ বলি না। অযথা দুশ্চিন্তা করবে। বলি “একটা চাকুরির ইন্টার্ভিউ আছে।”

কাছের এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে আমার গন্তব্য জানাই। বলি, আমি ফিরে না এলে কোথায় কাকে জানাতে হবে। যদিও এতে কোনই লাভ নেই। আগের কিস্তিতে আমি দীর্ঘ সময় ফিরে আসি নাই। তাতে কারো কিছুই করার ছিল না।

এসবি লোকাল অফিসে সময়মত পৌঁছাই। দেখি রাস্তার পাশেই এসআই রহমত দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে তিনি গম্ভীর মুখে রিসিভ করে একটা অফিসে প্রবেশ করেন। আমি একটা কক্ষের বাইরে বেঞ্চে বসে অপেক্ষা শুরু করি। একটু পর এসআই রহমত আমাকে এসে বলেন, “স্যার ভিতরে যান। আপনাকে ডাকা হয়েছে।”

আমি কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করি। সাদামাঠা একটা সরকারী অফিসের কক্ষ যেমন হয়। একটা টেবিলের পিছনে তিনজন মানুষ বসে আছেন। মাঝের জনের সামনেই টেবিল। বাকীরা কেবল চেয়ার পেতে বসেছেন। বুঝা গেল, মাঝের জন নেতা গোছের কেউ হবেন। তবে তিনি ভদ্র। দাঁড়িয়ে আমাকে সালাম দিলেন। তিনজনেই উঠে দাঁড়ান।

“আসসালামু আলাইকুম স্যার। আপনাকে কষ্ট দিয়ে খুলনা থেকে নিয়ে এলাম। আসার জন্য ধন্যবাদ।”

এই কৃত্রিম বিনয়ে আমার আরও অস্বস্তি লাগে। আমি সালামের জবাব দিতেও ভুলে যাই। চুপ করে থাকি। উনারা আমাকে বসতে বলেন। উনাদের ঠিক সামনেই একটা চেয়ার পেতে বসি।

‘স্যার আমরা তিনজন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার। আপনি বোধ হয় এতক্ষনে সেটা বুঝতে পেরেছেন।”

আমি কথা বলি না। আমি উনাদের চোখের দিকেও তাকাই না। আমার নার্ভাস লাগে।

“স্যার আপনার সময় হয়তো কম। সরাসরি কাজের কথায় আসি।”

আমি মাথা নিচু করে কথা শুনি।

‘স্যার, আমাদের উপরের নির্দেশ এসেছে। আপনাকে আমরা মেরে ফেলবো।”

আমি শুরুতে ভাবি, হয়তো ভুল শুনেছি। আমি চুপ থাকি। মেঝের দিকে চেয়ে আছি।

‘স্যার শুনেছেন? আপনাকে আমরা মেরে ফেলবো।”

আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা প্রবাহ এক সেকেন্ডের কম সময়ের জন্যে বয়ে যায়। এরপর আবার সব ঠিক। আমি লম্বা করে দম নিই।

“স্যার আপনার কি কিছু বলার আছে?”

এবারে আমি মাথা তুলি। অফিসারদের দিকে তাকাই। এক মুহূর্তের জন্য আমার চোখে অসংখ্য ঘটনার ফ্ল্যাশব্যাক হয়। পিলখানা হত্যাকাণ্ড, সেনাবাহিনীর ভূমিকা, আমাদের ভূমিকা, আমার দুর্ভাগ্য, অবর্ণনীয় সাফারিং, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের মুখ, আমার বর্তমানে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।

এবং সেই মুহূর্তে আমার ভিতর থেকে নার্ভাসনেস উধাও হয়ে যায়। আমি মাঝের অফিসারের চোখের পানে তাকাই।

“এই দেশ কারো বাবার একার না। আমার বাবা একজন রনাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। এই দেশ আমার বাবারও।”

এসবি অফিসারকে বিস্মিত মনে হয়। তিনি সম্ভবত আমার এই রিঅ্যাকশন আশা করেন নাই।

আমি বলে যাই।

‘আপনার ঊর্ধ্বতন অফিসারদের জানাবেন, আমি অনেক দেখেছি। আমার মৃত্যুভয় নাই। আমি আমার বাপের দেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না। আপনারা যা পারেন করেন।”

স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার আর কোন কথা না বলে আমাকে চলে যাবার ইশারা করেন। আমি বাইরে বের হয়ে এসে দাঁড়াই। আমার সামনে গম্ভীর মুখে এসআই রহমত, তিনি বিমর্ষ। সেদিনের আবহাওয়া খুবই বিমর্ষ। একটা স্যাঁতস্যাঁতে মন খারাপ করা ভাব। আমি বিদায় নিয়ে চলে আসি।

এই ঘটনা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ হুবহু লিপিবদ্ধ করে। প্রায় দুই বছর পর আমি জানতে পারি, আমার এই জবাব ফাইলে লিখিত আকারে নথিবদ্ধ করা হয়েছিল।

এরপর অনেক ঘটনা ঘটে। সেগুলো বলা আজ উদ্দেশ্য না।

এই ঘটনার প্রায় ৮ বছর পর ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করে। সেখানে টেলিভিশনে এক সন্ধ্যায় তাঁদের একটা শ্লোগান শুনতে পাই,

“লাখো শহীদের রক্তে কেনা

দেশটা কারো বাপের না।”

আমি নিজের অজান্তেই মুচকি হাসি। আমার স্মৃতিপটে স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসের সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে। আমার সেই একরোখা এবং হঠাৎ জড়তা ভেঙ্গে ফেলা নিজেকে মনে পড়ে।

উপলব্ধি করি, দুনিয়ার সকল প্রান্তে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মজলুমের ভাষা একই হয়!

রাজীব হোসেন

৯ আগস্ট ২০২৪

পিলখানা হত্যাকান্ড তদন্ত
Scroll to top