bdupdates.org

বাংলাদেশের সংকলিত সব আপডেট

আয়নাঘর গল্প – ৯

আলহামদুলিল্লাহ দেশ স্বাধীন হওয়ায় পর আজকে একটু মন খুলে কিছু কথা বলব ইনশা আল্লাহ। এতদিন আমার গলা চেপে ধরে রাখা হয়েছিল শুধু দেশপ্রেমিক “কনক সরওয়ার” ভাইকে একটা দীর্ঘ মেইলের মাধ্যমে জানিয়ে রেখেছিলাম। আজকের পোস্টে আমি আমার নিজের কষ্টের কথা কিছু বলব না। দুইবার মোট (১০+১১) ২১ দিন গুম এবং জেলের ৫ মাসের বিস্তারিত লিখলে কয়েকশ পাতার বই লিখতে হবে। আমার কষ্টগুলো আমি শুধু আমার রবের কাছে নিবেদন করেছি। এই ১.৫ বছরে নামাজের পর একটা দোয়া করতাম, হে আল্লাহ! এই জালিমের কাছ থেকে তুমি এই দেশকে রক্ষা করো।

২০২১ সালের ৩১ শে জানুয়ারি! বগুড়া থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর দুপুর ২ টার দিকে তেজগাঁও লিংক রোডে কয়েকজন সিভিল পোশাকধারী লোক আমার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার গাড়ির দরজা খুলে আমার ড্রাইভারকে সরিয়ে একজন বসে পড়ে। আমাকে ফেসবুকের একটা ছবি দেখিয়ে বলে, এটা আমি নাকি। আমি হ্যাঁ বলার পর তারা আমাকে বলে সামনের পেট্রোল পাম্পে আমাদের স্যার আছে উনি আপনার সাথে একটু কথা বলবে। আমি কিছু বলতে গেলেই বলে, একদম চুপ থাকুন বলেই চোখ বেধে ফেলে। কিছুক্ষন পর তারা আমাকে মিন্টু রোডের ডিবি অফিসের কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রাসন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) তে নিয়ে যায় (এটা যে সিটিটিসি তা কয়েকদিন গুম থাকার পর জানতে পারি)। এখানে নীচতলায় এবং ৭ তলায় এমন কিছু রুম আছে যেখানে কোনদিন সূর্যের আলো পৌঁছাই না। এখানে নীচতলায় আছে ৭ টি রুম আর ৭ তলায় আছে ৬ টি রুম। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় আমি এজম্যার সমস্যার কারনে শ্বাসকষ্টে ভোগার পরেও রাত ১১ টা পর্যন্ত অমানুষিক নির্যাতনের পর যখন ২য় আয়নাঘরে আমাকে ফেলে রেখেছিল তখন দেখলাম আমার চেয়ে হাজারগুণ হতভাগা কয়েকজন কয়েকবছর ধরে এখানে মৃতের মতো পড়ে আছে। আমার স্ত্রী উম্মে হাবিবা মিম, আমার দুই কন্যা, আমার মা-বাবা, আমার ভাই-বোন, শশুর-শাশুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছের কিছু বড় ভাই, ছোট ভাই এবং আমার গুটিকয়েক বন্ধু (সুসময়ের বন্ধু না) ছাড়া কেউ তখন পাশে ছিল না। বগুড়া থেকে আমার স্ত্রী উদভ্রান্তের মতো সারা দেশে ১০ দিন ঘুরেও আমার একবিন্দু কোন খোঁজ পায়নি। কোন থানা জিডি গ্রহণ করেনি। শেষে তারা আমার লাশ পাওয়া যায় কিনা তার খোঁজ নিচ্ছিল। সারা দেশে এমন কোন স্থান নাই যেখানে একজন নারী হয়েও সে খোজ নেয়নি। ১০ দিন পর অনেক চেষ্টা ততবীরের পর আমার কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল তারা। কিন্তু কষ্টের তখনো শেষ হয়নি শুরু মাত্র…

২০২২ সালের ৬ই অক্টোবর! আমার পরিবারসহ কুয়াকাটা থেকে ফেরার পর রাত ৯ টার দিকে ন্যাম গার্ডেন সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টারের বাসায় একসাথে হুড়মুড় করে ১০-১২ জন সিভিল পোষাকধারী ঢুকে সমস্ত বাসা তছনছ করে কিছু না পেয়ে পরিবারের সবার মোবাইল এমনকি আমার মেয়েদের ট্যাব এবং বাসায় বুয়ার মোবাইলসহ আমাকে আবার তুলে নিয়ে গেল। তাদের প্রত্যেকের মুখ ঢাকা এবং মাথায় ক্যাপ ছিল। কালো মাইক্রোবাসে তোলার সাথে সাথেই তারা আমার চোখ বেধে ফেলে। আরো একবার আমার পরিবারের উপর নেমে এল বিভিষীকাময় কয়েকটি দিন। একেকটি দিন আমার আর আমার পরিবারের জন্য হয়ে গেল এক বছরের মতো। যে পরিবার এই নারকীয় ঘটনা ফেস করে তারা জানে পৃথিবীটা কত কঠিন। ১১ দিনে যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছে না সেখানে আমি দেখেছি না চেনা কিছু ভাইকে যাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাটিয়ে নিয়ে যেত কিন্তু সারাদিন নির্যাতনের পর ফেরত নিয়ে আসত কোলে করে। ইলেকট্রিক শক, উল্টো করে ঝুলিয়ে বেদড়ক পেটানো ছিল সবচেয়ে আরামদায়ক নির্যাতন। একটা ভাইকে দেখেছিলাম তাকে নির্যাতন করতে করতে টায়ার্ড হয়ে পায়ে রড দিয়ে এমনভাবে আঘাত করেছে যার ফলে পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। আমাকে যে প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছিল সেখানে নাকি আগে আমার দেশের সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মাহমুদুর রহমান স্যারকেও নাকি রাখা হয়েছিল। কয়েকদিন পর আমার রুমে নিয়ে এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক যুগ্ন সম্পাদক আশিক ভাইকে। কয়েকদিন গুম রাখার পর উনাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়, যে মামলার ২য় আসামী হচ্ছে শ্রদ্ধেয় Pinaki Bhattacharya – পিনাকী ভট্টাচার্য দা। আমাকে মামলার ব্যাপারে তারা আরো উৎসাহিত ছিল কারণ আমার বাড়ি চট্টগ্রাম আর আমার স্ত্রীর বাড়ি বগুড়া।

১১ দিন গুম রাখার পর আমাকে ২ বছর আগের একটি “সন্ত্রাস বিরোধী মামলা”য় ফার্মগেট থেকে গ্রেফতার দেখিয়ে ৩ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। যে মামলার এজাহারে আমার কোন নাম নেই। রিমান্ডে অমানুষিক নির্যাতন করে আমাকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি (১৬৪) দেওয়ার জন্য আদালতে নেওয়া হয়। আমি জবানবন্দি দিতে অস্বীকার করায় তারা আমাকে আবার ৩ দিনের রিমান্ডে নিয়ে আসে। এইবারের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আমি অসুস্থ হয়ে গেলে আমাকে পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসে আমাকে চোখ বেধে সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামানের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। তার নির্যাতনে আমার হাত ফুলে ডোল হয়ে যায়। সে বলে যদি এইবার জবানবন্দি না দেই তাহলে আমার দুই সন্তান এবং আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে এসে নির্যাতন করবে। সারারাত কান্না এবং শরীরে ব্যাথা যন্ত্রনায় আমি ঘুমাতে পারিনি। ২৩শে অক্টোবর জবানবন্দি দেওয়ার পর তারা আমাকে কারাগারে প্রেরণ করে। ৫ মাস কারাগারের সেলে নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করার পর আমি স্থায়ী জামিন নিয়ে বের হতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। কারাভোগের যন্ত্রণার কথা উল্লেখ করতে গেলে আরো কয়েকশ পাতা লিখতে হবে।

২০১২-১৩ সাল থেকে আমি ফেসবুকে লেখালেখি করি। জাতীয়তাবাদী ঘরনার একটি প্লাটফর্ম ছিল যার নাম “জেড ফোর্স সাইবার ট্রুপস”। ফসিউল আলম ভাই, জাতির নানা, নোমানি ভাই, ডা: রাশেদ সহ আমরা অনেকেই সেখানে লেখালেখি করতাম। ২০১৭ সালে আমার একটি অন্য আইডি থেকে ” পিলখানা হত্যাকাণ্ড, দেশের সার্বভৌমত্ব” নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী একটা পোস্ট করেছিলাম। সেইসময়ে লেখাটি অনেক ভাইরাল হয়েছিল। তখন থেকেই তারা আমাকে নজরদারিতে রেখেছিল। ২১ সাল পর্যন্ত ঐ আইডি থেকে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন নিয়ে অনেকগুলো পোস্ট করা হয়েছিল। গতকাল আয়নাঘরের বর্ননা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় ছোট ভাই “এনামুল হক মনি” একটি লাইভ করেছে যা ইতিমধ্যে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রিয় ছোট ভাইটির সংগে দেশ নিয়ে অনেক কথা হতো।

নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপ্ররাক্রমশালী। তিনি ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। এই কয়েকবছর আমার পরিবারে কোন ইদ ছিল না। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি কয়েকমাস ট্রমায় ছিলাম। আমার আবেদন “আয়নাঘর ২” সিটিটিসিতে যেসব হতভাগারা এখনো গুম হয়ে আছে তাদের উদ্ধার করুন এবং এই গুমের সাথে যারা যারা জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনুন। দেশে আর একটি মানুষও যেন গুম খু নের স্বীকার না হয় সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

আমার কাছে সেই সময়ে দায়িত্বরত সকল পিচাশদের নাম মুখস্ত আছে। যদি কারো প্রয়োজন হয় তাহলে যোগাযোগ করবেন। আজ এই পর্যন্তই। সামনে ধাপে ধাপে আরো অনেক স্মৃতি আপনাদের সাথে শেয়ার করব ইনশা আল্লাহ।

__
মোঃ মহসীন ইমাম

আয়নাঘর গল্প – ৯
Scroll to top