আমি মাহদি হাসান। আপনাদেরকে আজ আমার গল্প বলব, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প। আমার গল্পটা ভিন্ন, পাশ করে যাওয়ার পরেও সবাই যেমন তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে সুখ অনুভব করে, আমি তা করতে পারবো না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নির্যাতন, আতঙ্ক আর সহপাঠীদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা এক সৌভাগ্যবানের(!) গল্প। আমার গল্পটা একটু বড়। একবার না, তিন তিনবার হায়েনারা আমার উপরে পাশবিক নির্যাতন চালায়। সাথে যুক্ত হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছি প্রায় চার বছর হল। কিন্তু এখন ও মাঝে মাঝে মনে হয় মাঝরাতে দরজায় ওরা কড়া নাড়ছে, ধড়ফড়িয়ে উঠি। আশেপাশে তাকিয়ে যখন বুঝি এটা আমার বাসা, কুয়েটের বঙ্গবন্ধু হল না, তখন শান্ত হই। বাবা ছিল হাই স্কুলের শিক্ষক, মা সরকারী কর্মচারী। বরিশালে শৈশব কেটেছিলো আমার। এইচএসসি পাশ করি ঢাকা কলেজ থেকে।
হ্যা, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আগের গল্পটাও সংগ্রামের, কিন্তু সেই সংগ্রামের গল্পের মাঝে ছিল স্বপ্ন; ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন। সব সময় একটা তাগাদা ছিল বুয়েটে পড়বো, দ্রুত পাশ করে পরিবারের দায়িত্ব নিবো। কিন্তু বুয়েটে না পেলেও কুয়েটে চান্স পাই। কুয়েট সম্পর্কেও একটা ভাল ধারনা ছিল। তাই কুয়েটে ভর্তি হয়ে যাই।
কুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বেশি বড় নয়, কিন্তু সব কিছু খুব গোছানো, পরিপাটি। ভেবেছিলাম সামনের কয়েকটা বছর স্বপ্নের মতই সময় কাটবে। প্রথম বর্ষে হলে সিট সংকট আর গনরুমে থাকা বন্ধুদের কাছ থেকে র্যাগিং এর নোংরা কালচার সম্পর্কে জেনে বাইরে মেসে থাকার সিদ্ধান্ত নিই।
দ্বিতীয় বর্ষে হলে ওঠার চেষ্টা করি এবং বঙ্গবন্ধু হলের ৩০৫ নাম্বার কক্ষে সিট বরাদ্দ পাই। কিন্তু এখানে ও বিধি বাম । আমার জন্য বরাদ্দকৃত সিটে উঠতে গিয়ে শুনি ঐ সিটে উঠা যাবে না। কারন সিটটা পলিটিকাল। তাদের অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ এখানে উঠতে পারবে না। তখনই বুঝতে পারি যে, হল প্রশাসন থেকেও অধিক শক্তিশালী একটা গ্রুপ আসলে হলের হর্তা কর্তা হয়ে আছে। অবশেষে অনেক অনুনয় বিনয় করে, অনেকের রেফারেন্স দিয়ে, আমার জন্য বরাদ্দকৃত সিটটা আমাকে বুঝে নিতে হয়েছিল।
তবু হল জীবনের শুরুটা মন্দ ছিল না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গল্প, ঘুরাঘুরি, খেলাধুলা, পড়াশোনা সবই ঠিক মত চলছিল। ক্যাম্পাসটাকে বেশ আপন করে নেওয়া শুরু করেছিলাম। আর প্রথম বর্ষে র্যাগিং এর ভয়ে ঠিক ক্যাম্পাসে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারতাম না। তাই দ্বিতীয় বর্ষে উঠে মুক্ত বাতাসের স্বাদ নিচ্ছিলাম। কিন্তু সেই স্বাধীন ভাবে চলার সুযোগ বেশি দিন থাকে নি।
১ম দফা নির্যাতনঃ
২০১৭ সালের ১লা মে এর রাত। তারিখটা আমার বেশ মনে আছে। পরের দিন আমার পরীক্ষা ছিল। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো রাত সাড়ে বারোটার দিকে। আইইএম ১৫ ব্যাচের রাহুল, তাশদীদসহ মোট চার জন এসে আমাকে ডেকে নিয়ে যায় হলের গেস্ট রুমে। গেস্ট রুমে যেয়ে দেখলাম সেখানে আমার পরিচিত দুইজন সিনিয়র নাইম ভাই এবং রুম্মন ভাইকেও ধরে নিয়ে আসা হয়েছে।
দৌলতপুরে একটা কোচিং সেন্টারে একসাথে পড়াতাম আমরা। পরে জানতে পারি ঐ কোচিং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবার নাম দৌলতপুর থানার ওসি এস এম আনোয়ার হোসেন শিবির সন্দেহভাজন হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টার এর কাছে জমা দেয়। তখন রেজিস্টার ছিলেন ড. মোঃ শহিদুল ইসলাম এবং ভিসি ছিলেন ড. আলমগীর। রেজিস্টার তখন লিস্টটা কুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি মেকানিকাল ০৮ ব্যাচের সাফায়েত নয়নের কাছে দেয়।
বুঝতে পারছিলাম জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় দীর্ঘ একটা রাত পার করতে যাচ্ছি আমি। চেষ্টা করছিলাম সাহস রাখার। শুরু হল জেরা-
শুরুটা করে আমি নাইম ভাইকে কিভাবে চিনি এই প্রশ্ন দিয়ে। ঠিক তার পরপরই আইইএম-১৪ এর সামিউর রহমান এবং বিইসিএম-১৩ এর তারেক নাইম ভাইকে বেধড়ক পিটাতে থাকে। অসহায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দেখা ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। মনে হচ্ছিল এক পাল হায়েনা তার শিকারের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। সদা হাস্যোজ্জ্বল নাইম ভাই তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। কিন্তু তারপর ও থামে না ওদের নিষ্ঠুরতা। অবশেষে নাইম ভাইয়ের মাথা ফেটে রক্তের ফিনকি বের হলে তারা নাইম ভাইয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে আমাদের দিকে নজর দেয়। আমার উপর নির্যাতন শুরু হয় কুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সিএসই’১৩ ব্যাচের সাদমান নাহিয়ান সেজানের দ্বারা।
সেজান সেদিন তার হিংস্রতার সবটুকু দিয়ে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। এলোপাতাড়ি চড় ঘুষি তো ছিলই, সেই সাথে লাঠি, স্ট্যাম্প ও রড দিয়ে আমাকে বেধড়ক পেটাচ্ছিল। পিটাতে পিটাতে ক্লান্ত হয়ে বিরতি দিয়ে সে আবার মার শুরু করতো। আমার সারা শরীর ব্যাথায় কুকড়ে যাচ্ছিল। সাথে তারেক (বিইসিএম’১৩), দুর্জয় (আইইএম’১৪) আর ফয়সাল (আইইএম’১৫) আমার পায়ে নির্দয়ভাবে আঘাত করছিল। আমার পায়ের আঙ্গুলের নখ খুলে চলে আসে। আমার মনে হচ্ছিলো আমি আর কোনোদিন পায়ের উপর ভর করে হাঁটতে পারব না। তারা আমার মুখেও চড় ঘুষি মারছিল। যার ফলশ্রুতিতে আমি চোখে আঘাত পাই; যেই আঘাত এখন ও আমাকে ভুগাচ্ছে। আমি ভাবছিলাম তাদের এই অত্যাচার কি আদৌ শেষ হবে নাকি তার আগেই আমি আমার আল্লাহর কাছে পৌঁছে যাব।
অবশেষে সেই দীর্ঘ কঠিন রাত শেষ হয়। আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া যে আমি তখনও বেচে ছিলাম। সেই রাতে আমার মত আরও অনেকের উপর এমন অমানবিক নির্যাতনের খড়গ নেমে এসেছিল। আমার ব্যাচেরই আরও তিনজন ছিল। এর মধ্যে ইউআরপি’১৪ এর লুতফর ভাইয়ের উপর হওয়া পাশবিক নির্যাতনের জন্য তার দুইটা কিডনিই প্রায় ড্যামেজ হয়ে যায়। এমনকি তার বেঁচে থাকা নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হইয়েছিলো।
সকাল বেলায় পুলিশের হাতে আমাদেরকে হস্তান্তর করে দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের হাত থেকে মুক্ত হয়ে পুলিশের হাতে আমাদের বন্দী হতে হয়। অথচ নির্যাতনকারীরা ছিল বহাল তবিয়তে। তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যোগাযোগ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পিতৃতুল্য শিক্ষকেরা নির্যাতনের সহযোগী হয়ে আমাদের মত নির্যাতিতের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
সেদিন বিভিন্ন হল থেকে মোট চৌদ্দ জনকে খান জাহান আলী থানাতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ছাত্রলীগের নির্যাতনের পরে আমরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরও স্বীকার হই। আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। একমাস খুলনা কারাগারে থাকার পরে আমার জামিন হয়। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে আনঅফিসিয়ালি বহিষ্কার করা হয়।
এরপর থেকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন আর কখনোই আগের মত ছিল না। আমার চেনা বিশ্ববিদ্যালয়টা আমার কাছে অপরিচিত হয়ে গেল, নিজেকে মনে হতো আগন্তুক। ক্যাম্পাসে থাকতে ভয় লাগতো, কোনো রকমে পরীক্ষা এবং ল্যাব দিয়েই চলে আসতাম। তাই আমার পক্ষে পড়াশোনাতেও আর ভাল করা সম্ভব হয় নি।
২য় দফা নির্যাতনঃ
২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি আমি আবারও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের শিকার হই। ক্যাম্পাসে যখন ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়ার সময় হতো তখন তৎপরতা দেখানোর জন্য, আবার কখনও বা নিজেদের অন্তঃকোন্দল ধামাচাপা দিতে ওরা এরকম কয়েকজনকে টার্গেট করে অত্যাচার করতো।
সাদমান নাহিয়ান সেজান ততদিনে কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে গিয়েছে। সেই সব থেকে বেশি অত্যাচার করে এবং তার সাথে যোগ দেয় তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি সিভিল’১০ এর শোভন। এখন সে সরকারি চাকরি করে, সহকারী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এলজিইডিতে আছে। আরো ছিল নিবিড় (বিএমই’১৪) এবং ফিরোজ (ইইই’১৩)। এদের সাথে সাজ্জাদ হোসেন দুর্জয় আর সামি আমার বিভাগের এবং ব্যাচমেট (আইইএম) ছিল- এরাই আমাকে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিয়েছে।
আমাকে এবং আমার বন্ধু ও ক্লাসমেট শাহীনকে (আইইএম-১৪) কে আমার বিভাগেরই ১৫ ব্যাচের রাহুল, তাশদীদ, ফয়সাল সহ কয়েকজন মিলে ১৪ ব্যাচের দুর্জয়ের নেতৃত্বে ক্লাস থেকে ধরে নিয়ে যায়। একটা ক্লাস শেষ করে আমরা অন্য একটা ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ক্লাসের উপস্থিতিতে আমাদের নামও ছিলো।
আমাদের দুজনকে নিয়ে বংগবন্ধু হলের ৩০১ নং রুমে নিয়ে যায়। সেখানে আমরা পৌঁছে দেখি আমার পরিচিত এক সিনিয়র আল আমিন (ইইই’১৩) ভাইয়ের উপরে অত্যাচার চলছে। তারা আল আমিন ভাইকে গামছা দিয়ে চোখমুখ বেঁধে মারছিল। আলামিন ভাইকে ওরা ক্রমাগত পায়ে এমনভাবে প্রহার করছিল যেন চিরদিনের জন্য পঙ্গু না করে থামবে না। সে সময়ে নিবিড় রেজা (বিএমই’১৪), ফিরোজ (ইইই’১৩) এবং আরো অনেকে ছিল যাদের সবার নাম মনে নেই।
কিছুক্ষন পরই আমার পালা আসে। বিভিন্ন বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় জেরা আর অত্যাচার শুরু হয়। জেরার থেকে অত্যাচারের প্রতিই তাদের আগ্রহ ছিল বেশি। এবারেও আগের বারের মত ভয়ঙ্করভাবে পেটায় আমাকে। মানুষ বোধ হয় সাপকেও এত ভয়ঙ্করভাবে মারে না। অত্যাচারের একপর্যায়ে দুর্জয় (আইএম’১৪) আমার মাথায় আঘাত করলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই এবং সেবারের মত রক্ষা পাই।
কিছু পর গেস্ট রুমে নিজেকে আবিস্কার করি, অতঃপর আবার পুলিশ, থানা, গারদ, জেল-হাজত, কোর্ট, মামলা মোকাদ্দমা। এবারে আমাদেরকে অস্ত্র মামলা দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের ওরাই কিছু অস্ত্র পুলিশের হাতে দিয়ে বলে যে ওগুলো আমাদের থেকে পাওয়া গেছে যা ছিল পুরোপুরি মিথ্যা। আমাদের কাছে অস্ত্র থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ওরাই আমাদেরকে ক্লাস থেকে ধরে এনেছিল। এমনকি ক্লাসের এটেনডেন্ট শীটে আমাদের উপস্থিতি উল্লেখ ছিল। পুলিশও জানতো যে অস্ত্র আর বুলেটগুলো ছাত্রলীগের ওদেরই। তখন কুয়েট প্রশাসন বা থানা পুলিশ সবই চলতো ছাত্রলীগের কথা মতো। যদিও এই মামলাটা পরবর্তীতে আদালতে খারিজ হয়ে যায়। তারপরেও তখন এক মাস দশ দিন কারাগারে থাকতে হয়। থানায় রিমান্ডও হয় ১ দিন এই মামলায়।
সেবার দুর্জয় আমার মোবাইল ফোনটা নিয়ে যায় যেটা আমার খালা ইটালি থেকে আমার জন্য গিফট পাঠিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার নির্যাতনের পরে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আমার জন্য আরও কঠিন হয়ে যায়। সবসময়ই একটা আতঙ্ক কাজ করত। ততদিনে বাবা মারা যাওয়ায় এবং পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়ায় পরিবারের আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠি আমি। আমার উপরে দুই বার এমন নির্মম অত্যাচার হওয়ায় আমার পরিবারও একদম ভেঙ্গে পড়ে। আমার মা অপেক্ষায় থাকতেন কবে কুয়েট নামের এই ‘নরক’ থেকে আমি পাশ করে বের হবো।
৩য় দফা নির্যাতনঃ
কিন্তু আমার উপরে ছাত্রলীগের ক্ষোভ তবু যেনো শেষ হয় না। শিক্ষা জীবনের ইতি টানার আগে আমাকে আরো একবার অত্যাচার এবং মামলার শিকার হতে হয়। ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে আমি অনেক কষ্টে শিক্ষা জীবন শেষ দিকে নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন (২৪ মার্চ ২০১৯) ছিল আমার চূড়ান্ত বর্ষের বিদায় অনুষ্ঠান। আগের দেওয়া অস্ত্র মামলায় মিথ্যা সাক্ষী দিতে গিয়ে আমার আইনজীবীর হাতে নাজেহাল হওয়ার কারণে ছাত্রলীগের সেজান (সিএসই’১৩) ও ফিরোজ (ইইই’১৩) ক্ষোভ থেকে আমাকে আবারো টার্গেট করে। আমি যখন অডিটোরিয়াম থেকে নামছিলাম তখন ওরা অনেকে মিলে আমাকে ধরে এবং ফজলুল হক হলের টিভি রুমে নিয়ে গায়ে গরম পানি ঢালে।
এবার সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করে লেদার’১৪ ব্যাচের তিলক। চোখ মুখ হাতে এত প্রচন্ডভাবে আঘাত করে যে আমার বাম চোখটা নষ্টই হয়ে যাবে মনে হচ্ছিলো। আমার সাথে নির্যাতনের শিকার হয়ে শাহিনের ১টা কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। ও দীর্ঘদিন আবু নাসের হাসপাতালে এ ভর্তি ছিল। এবারের নির্যাতনে জড়িতদের মধ্যে তিলক (লেদার’১৪), সেজান (সিএসই’১৩), জামান ইব্রাহিম (সিএসই’১৪), আহসানুল আবেদিন রিদয় (আইইএম’১৭), তন্ময় (লেদার’১৪), শুভ (লেদার’১৫) আর রাসিন জামানের (লেদার’১৫) কথা মনে আছে। সাথে আরও অনেকে ছিলো, বাকিদের কথা পরিস্কার মনে নেই।
এবার যখন ওরা আমাদেরকে মারছিলো, সেখানে ইকোনোমিক্সের লেকচারার শাহরিয়ার রোমান এবং আমারই বিভাগের একজন শিক্ষক পলাশ সাহা (আইইএম’১৩) উপস্থিত ছিলো। তারা আমাদেরকে রক্ষা না করে বরং নির্দেশনা দিচ্ছিলো, “সেন্সিটিভ কোন যায়গায় মারিস না, কোন সমস্যা হয়ে গেলে বিপদে পড়ে যেতে হবে।”
আমি, রেজা আর শাহিন-১৪ ব্যাচের এই তিনজনকে ফেয়ার ওয়েল থেকে ধরে নিয়ে অত্যাচার করে, সাথে মেহেদি (লেদার’১৭) কেও মারার পরে আমাদের একসাথে পুলিশে দেয়। পরিশেষে আবার পুলিশ, থানা, গারদ, জেল-হাজত, কোর্ট, মামলা মোকাদ্দমা। এবার দশ দিনের সংক্ষিপ্ত কারাজীবনের ছয় দিনই হাতকড়া পরা অবস্থায় খুলনা মেডিকেল এ ভর্তি ছিলাম। এই মামলাটাও পরে খারিজ হয়ে গিয়েছে।
আমাকে তিন দফায় নির্যাতনে জড়িত যাদের কথা আমার পরিস্কার মনে আছে তারা হলো-
১. সাদমান নাহিয়ান সেজান (সিএসই’১৩)
২. শাফায়েত হোসেন নয়ন (মেকানিকাল’০৮)
৩. তারেক রহমান (বিইসিএম’১৩),
৪. সাজ্জাদ হোসেন দুর্জয় (আইইএম’১৪)
৫. মোঃ ফয়সাল (আইইএম’১৫)
৬. তাশরিফ সালেহ রাহুল (আইইএম’১৫)
৭. তাশদীদ (আইইএম’১৫)
৮. নিবিড় রেজা (বিএমই’১৪)
৯. ফিরোজ (ইইই’১৩)
১০. তরিকুল তিলক (লেদার’১৪)
১১. জামান ইব্রাহিম (সিএসই’১৪)
১২. আহসানুল আবেদিন রিদয় (আইইএম’১৭)
১৩. রাসিন জামান (লেদার’১৫)
১৪. তন্ময় (লেদার’১৪)
১৫. শুভ (লেদার’১৫)
১৬. শাহরিয়ার রোমান (শিক্ষক-ইকোনমিকস)
১৭. পলাশ সাহা (শিক্ষক-আইইএম’১৩)
হ্যা, এটাই আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প; কুয়েট নামের ‘টর্চার সেলে’ চার বছর কাটানোর গল্প। সেখানে চাইলেই কাউকে বেধড়ক পিটিয়ে, মুমূর্ষু অবস্থায় পুলিশের কাছে সোপর্দ করা যায়। আবার নির্যাতনকারীরাই হয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সমান্তরাল আরেক প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বন্ধু, শিক্ষকের সহানুভূতি ও সহযোগিতা পেয়েছি কিন্তু সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের কাছে তারাও অসহায়ত্ব প্রকাশ করতো। কিছু ভালো স্মৃতিও আছে তাদের সাথে। কিন্তু সেই স্মৃতিগুলো ঢেকে গিয়েছে আতঙ্ক ও নির্যাতন দিয়ে। প্রায়ই মনে হয়, ইশ! যদি আতঙ্ক ও নির্যাতনের এই স্মৃতিগুলো সত্য না হতো কিংবা মুছে ফেলতে পারতাম স্মৃতির মানসপট থেকে।
মাহদি হাসান
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ম্যানেজমেন্ট’ ১৪ ব্যাচ, কুয়েট
ফুটনোট: মাহদির উপরে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা ও নির্যাতনের সময়ে অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা ‘সোচ্চার’ এর পক্ষ থেকে যাচাই করা হয়েছে এবং তখন কিছু মিডিয়াতেও প্রকাশিত হয়েছিলো (লিংক কমেন্টে)। তবে নির্যাতনে তাদের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা মাহদির জবানবন্দী ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে যাচাই করা যায় নি এবং অভিযুক্তদের মন্তব্য নেওয়ার জন্য সোচ্চারের পক্ষ থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।
সম্ভাব্য শাস্তি: বাংলাদেশ দন্ডবিধি ৩০৭ ধারা অনুযায়ী অপরাধ প্রমানিত হলে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ৩২৫ ধারা অনুযায়ী সর্বনিম্ন সাত বছরের কারাদন্ড ও জরিমানা হতে পারে।